রাশিয়া বিশ্বকাপে বিপর্যয়ের পর পুহাতোর ছোট্ট গ্রামের লিওনেল স্কালোনি নামের লোকটিকে যখন আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়, অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি। কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনাও প্রবল সমালোচনা করেছিলেন। সেই স্কালোনির হাত ধরেই এখন বিশ্বকাপে ৩৬ বছরের শিরোপা খরা কাটানো থেকে স্রেফ একটি জয় দূরে আর্জেন্টিনা।
তিন বছরে তিনটি ফাইনালে হারের পর ২০১৬ সালে যখন জাতীয় দলকে বিদায় বলে দেন মেসি, খবরটি স্কালোনি বিশ্বাসই করতে পারেননি।
মেসিকে ঘিরে আছেন প্রতিপক্ষের কয়েকজন খেলোয়াড়, সাবেক সতীর্থের এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে স্কালোনি লিখেছিলেন, “এই ছবিই সবকিছু বলে দিচ্ছে… যেও না, লিও। ”
মেসিকে তার অবসরের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য রাজি করাতে ওই সময়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন স্কালোনি। পরে আবার জাতীয় দলের জার্সিতে ফেরেন মেসি। গত কয়েক বছরে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলের সবচেয়ে চমকপ্রদ গল্পগুলির চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে এই স্কালোনির হাত ধরে। আর্জেন্টিনা দলকে তিনি তুলে নিয়েছেন অন্য উচ্চতায়।
২০১৮ সালের অগাস্টে আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এএফএ) যখন স্কালোনিকে অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব দেয়, তখন ফেডারেশনের যুব কার্যক্রমের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তখনকার ৪০ বছর বয়সী স্কালোনির পূর্বে প্রধান কোচ হিসেবে কাজের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।
২০১৫ সালে পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পরের বছর স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়ায় হোর্হে সাম্পাওলির সহকারী কোচ হিসেবে যোগ দেন স্কালোনি। পরের বছর সাম্পাওলি যখন আর্জেন্টিনায জাতীয় দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব পান, স্কালোনিও চলে আসেন তার সঙ্গে। ২০১৮ বিশ্বকাপে ভরাডুবি হয় আর্জেন্টিনার, ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরে বিদায় নেয় শেষ ষোলো থেকে। ছাঁটাই করা হয় সাম্পাওলিকে।
এএফএ খুঁজতে থাকে নতুন কোচ। একে একে প্রস্তাব দেওয়া হয় দিয়েগো সিমেওনে, মার্সেলো গায়াদো ও মাউরিসিও পচেত্তিনোকে। রাজি হননি তারা কেউ। স্থায়ী কোচ পাওয়ার আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্বে স্কালোনিকে দিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই থেকে শুরু আর্জেন্টিনার নতুন যাত্রা। সেই যাত্রায় একে একে টানা ৩৬টি ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়ে মেসিরা।
২০১৯ সালে কোপা আমেরিকার সেমি-ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। দুই বছর পর সেই ব্রাজিলকেই তাদের মাটিতে ফাইনালে হারিয়ে মহাদেশীয় টুর্নামেন্টটির শিরোপা ঘরে তোলে তারা। দেশের হয়ে মেসি পান প্রথম শিরোপার স্বাদ। কেটে যায় তাদের ২৮ বছরের শিরোপা খরা। মেসিও হয়ে যান অনেকটা ভারমুক্ত।
বছর না ঘুরতেই তারা ‘ফিনালিস্সিমা’ নামে আরেকটি ট্রফির স্বাদ পায় ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারিয়ে। তিন বছরের বেশি সময়ে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে দলটি পা রাখে কাতারে। কাতারে ফিফা বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের বিপক্ষে হোঁচট খায় আর্জেন্টিনা। সে ম্যাচের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লিওনেল স্কালোনির অধীন দলটির।
তার তত্ত্বাবধানে প্রতি ম্যাচকেই ফাইনাল হিসেবে ধরে খেলতে নেমে শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের ফাইনালে নামবেন মেসি, দি মারিয়ারা।
মরুর বুকে বিশ্বকাপের ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে আর একটি ম্যাচ জিততে হবে স্কালোনির দলের। আর সে ম্যাচ জিতলেই তৃতীয় শিরোপা ঘরে তুলবে আলবিসেলেস্তেরা।
এমন বাস্তবতায় আর্জেন্টিনার সাবেক বিশ্বকাপজয়ী কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি ও কার্লোস বিলার্দোর সঙ্গে সবর্কালের সেরা আর্জেন্টাইন কোচদের কাতারে নাম লেখাতে এক ধাপ পেছনে রয়েছেন স্কালোনি।
স্কালোনি কোচিং স্টাফ হিসেবে পেয়েছিলেন নিজের আইডল পাবলো আইমারকে। ছিলেন সাবেক সতীর্থ রবার্তো আয়ালা, ওয়াল্টার স্যামুয়েলও। সেই থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে স্কালোনির অধীন দলটি চলে গেছে বিশ্বকাপের ফাইনালে। রোববার তারা শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ খেলতে ফ্রান্সের বিপক্ষে।
আর্জেন্টিনা দলের ২৬ সদস্যের মধ্যে ১৯ জনই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। নবাগত সবাই এসেছেন স্কালোনির হাত ধরে।
আর্জেন্টাইনদের কাছে স্কালোনিও এখন প্রিয়, ভালোবাসার মানুষ। ১৯৭৮ সালে সেসার লুইস মেনতি ও ১৯৮৬ সালে কার্লোস বিলার্দো কোচ হিসেবে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে ঠাঁই পেয়ে গেছেন দেশটির ইতিহাসে। সেই অর্জন থেকে স্কালোনি স্রেফ এক ধাপ দূরে।